নাজনীন সুলতানা। তিনিই প্রথম কোনো নারী যিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন।
১৯৮০ সালেই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হোন। কম্পিউটার উপ-বিভাগে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তিনিসহ মাত্র চারজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলেন। তখন এ দলটি সবমিলিয়ে প্রায় ৮৫টি সফটওয়্যার তৈরি করে। যেগুলো ব্যাংকের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের অটোমেশন তৈরিতে তিনি ছিলেন নেতৃত্বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকে কাজ শুরু করা নাজনীন সুলতানার লেখা প্রথম প্রোগ্রাম ছিল আমদানি-রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে। ১৯৮৪ সালে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই বিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যার তৈরি করলেও নিয়মতান্ত্রিক জটিলতায় সে সময় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
১৯৮৯ সালে নাজনীন সুলতানা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ১৯৯৬ সালে একই বিভাগে সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী ডেপুটি ডিরেক্টর নির্বাচিত হন।
নাজনীন সুলতানা পড়াশোনা শেষ করে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) যোগ দেন। এরপর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পদার্থবিদ্যার রিচার্স ফেলো হিসেবে যোগ দেন। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেন এন্টারপ্রাইজ ডাটা ওয়্যারহাউস ও ব্যাংকিং প্রকল্পের পারচেজার হিসেবেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতেও (বিবিএস) কর্মরত ছিলেন নাজনীন সুলতানা।
নিজের সম্পর্কে নাজনীন সুলতানা বলেন, তার চেষ্টা তাকে অনেক কিছুতেই প্রথম করেছে। তিনিই প্রথম বাংলা সফটওয়্যার তৈরি করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজনসহ আরও দুজন কর্মকর্তা তাকে সহায়তা করেন।
তিনি বলেন, ‘কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সে তখন আমরা ছিলাম জার্মানিতে। সময়টা ১৯৮৪ সাল। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমি মাত্র চার বছর আগে যোগ দিয়েছি। সে সময় বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ছিল। কম্পিউটারে প্রশিক্ষিত লোকও ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। সেখানে আমি, মো. আজিজুর রহমান খান (সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক) এবং জয়নাল আবেদিন (পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক কর্মকর্তা) একই গ্রুপে ছিলাম। আমরা তিনজন মিলে ঠিক করলাম এমন একটা প্রজেক্ট করবো যেটা বাংলাদেশের মানুষের এখনই কাজে লাগবে। সেই সময় বাংলাদেশ ভারত মিলে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। আমরা সেই প্রজেক্টের নাম দিলাম ‘বাংলা মেশিন’। আমাদের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ছিলেন টমাস উইলিয়াম বুসন। আমরা প্রথমেই বাংলা সংখ্যা এবং অক্ষরগুলো ডিজাইন করতে প্রোগ্রাম লিখলাম। আমাদের গ্রুপের জন্য হোস্টেলের রুমেও কর্তৃপক্ষ একটা পিসি দিয়েছিল। সারাদিন ক্লাসে কাজ করছি আবার রাত জেগে বাংলা অক্ষর ডিজাইন করছি। সে সময় ই-মেইল, মোবাইল কিছুই ছিল না। দেশ থেকে চিঠি আসতেও ২০/২৫ দিন লেগে যেত। আমরা বাংলা সংখ্যা এবং অক্ষরগুলোকে বিভিন্ন কমিউনিকেশন কোডে অ্যাসাইন করি যার নাম দেই ‘বাসকি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’ প্রথম পাতা টাইপ করার পর প্রিন্ট হয়ে বের হয়ে এল। আনন্দে আমাদের গ্রুপের সবাই আত্মহারা। আমাদের কো-অর্ডিনেটরও আনন্দিত। আমাদের অভিনন্দন জানালেন। প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশনের দিন বিশেষজ্ঞদের কাছে আমাদের প্রজেক্টটি দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মার্চে বদরুন্নেসা কলেজের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম ডামি ও পরে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে যাবার প্রশিক্ষণ নেন। ডামি রাইফেল হাতে ঢাকার রাজপথে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের সেই বিখ্যাত মার্চপাস্ট এবং সশস্ত্র মহড়ার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, সংবাদ আদান প্রদান করেছেন। আহত মুক্তি যোদ্ধাদের নার্স হিসেবেও সেবা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে যুক্ত ছিলেন সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক গণ-সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি শেষ করে যোগ দেন মহিলা পরিষদে। বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন তিনি।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার বিজ্ঞান বই (অপসোনাল) চালু করা হয় নবম ও দশম শ্রেণিতে। সেই বইটিও লিখেছিলেন তিনি ও তার তিন সহকর্মী মিলে টেক্সটবুক বোর্ডের আওতাভুক্ত কম্পিউটার বিষয়ক প্রথম বই 'মাধ্যমিক কম্পিউটার বিজ্ঞান' লেখেন।
নাজনীন সুলতানা মনে করেন, স্রোতের বিপরীতে কাজ করে আমাদের সফলতার পথে যেতে হয়। তবে আমরা প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে পারি। কাজ ছাড়া এগিয়ে যেতে চাই না।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর ৪০ বছর পর ডেপুটি গভর্নর পদে একজন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, যে নারীরা কতটা পিছিয়ে আছে। একটা সময় মেয়েরা নিজেও মনে করতো, শীর্ষ পদে যাওয়ার বোধ হয় এই সমাজে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এখন মেয়েদের চ্যালেঞ্জ নেওয়া জরুরি। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা থাকলে নারীবান্ধব যেকোনো উদ্যোগ নেওয়াটা সহজ হয়।