করোনার এই বৈশ্বিক মহামারি আমাদের সামনে একটি বিষয় উন্মোচিত করেছে যা আমরা আগে তেমন একটা ভাবিনি। যেমন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ঘরে বসে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং-এর কাজ হচ্ছে অনেকদিন ধরে। আমি নিজেও আউটসোর্সিং-এর একটা কাজ করেছি ২০০৭ সালে। কাজ কিন্তু হচ্ছে তারও আগে থেকে। তবে, সেসব কাজের বড় অংশে টেকনিক্যাল ছোঁয়া ছিল। কিন্তু এখন যখন সবাই বাসায় বসে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে, আসলেই অনেক কাজ ঘরে বসেই করে ফেলা যায়। এমন কি মুদ্রিত দৈনিক পত্রিকার সব কাজই যে ঘরে বসে করা যায়, শুধু ছাপানোটা বাদে, তাই বা কে জানতো। এর অর্থ হচ্ছে আমরা যখন আবার আগের মতো কাজে ফেরত যাব তখন অনেক অফিস তাদের কর্মীদের জন্য নতুন ব্যবস্থাপনায় চলে যেতে পারে। দুটো কারণে এটা তারা করবে। প্রথমত মহামারির পরপরই বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেবে। সেজন্য সংস্থাগুলোকে সবধরণের খরচ কমানোর কথা ভাবতে হবে। ফলে অফিসগুলো স্লিম হয়ে যাবে। তারা কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করতে বলবে। আরও একটা কাজ হবে, সেটি হলো কম লোক দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া।
বাসা থেকে কাজ করার জন্য ভাল কর্মী দরকার। করোনাকালে সারা বিশ্বের মতো এদেশেও আমরা টের পাচ্ছি যারা সবদিক সামলে কাজ করতে পারে তাদের এখানে সম্ভাবনা বেশি। ফলে যেসব মেয়েরা যোগ্য হয়েও বাসায় বসে আছে তারাও ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ নিতে পারবে।
নতুন অনেক কাজ তৈরি হবে এবং বিদ্যমান অনেক কাজ বাড়বে। সেসবের জন্য নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে। এটা অবশ্য ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। সামনের দিনগুলোতে ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ ব্যাপারটাই বেশি মুখ্য হবে। কাজে বাসায় বসে হোক বা দৌড়াদৌড়ি করে হোক অবশ্যই নিজেদের আগে তৈরি করে নিতে হবে। এজন্য তাকে তথ্য যোগাড় করতে হবে। কোথায় কোন ইনফরমেশন আছে তা জানতে হবে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
বিডিওএসএন থেকে আমরা #মিসিংডটার নামে একটা পাইলট করেছি। তখন আমরা দেখেছি কয়েকটা বিষয়ে নজর দিতে পারলে মেয়েরাও সমান তালে এগিয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে প্রস্তুতির সহায়তা, আইডলদের সঙ্গে পরিচয় হওয়া কিংবা নেটওয়ার্কিং বাড়ানোর মতো সফটস্কিলগুলো রয়েছে হার্ডস্কিলের সঙ্গে। আর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের দক্ষতায় মেয়েরা অনেকখানি রয়েছে। গত দুই বছরে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তনে আমরা দেখেছি চ্যান্সেলর বা ডিন অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
বাসায় থেকে কাজের কথাটা এজন্য বললাম কারণ এখনও অনেকে বলে, ‘আমাকে বাসা থেকে কিছু করতে দেয় না’। আবার কেউ বলে, আমি চাকরি করতাম কিন্তু সন্তান জন্মের পর আর অফিসে ফেরা হয়ে ওঠেনি। আবার যখন সন্তানকে বড় করে কাজে ফিরতে চাইলাম ততদিনে দেখি ডোমেইন চেঞ্জ হয়ে গেছে। তখন নতুন করে কাজে ফেরাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। সংসার সন্তান সামলিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া কঠিন”। দুটোই এখন সম্ভাবনা।
বিশেষ করে সারাবিশ্বে অনলাইন পড়াশোনা একটা নতুন গতি পেয়েছে। আমার ধারণা, সামনে এটি আরও জোরদার হবে। ফলে ওই যে ডোমেইন চেঞ্জ হয়ে গেছে বলে হারিয়ে যাবার ভয় সেটা কিন্তু কাটিয়ে তোলা যাবে। কারণ বাসায় বসে নিজেকে প্রশিক্ষিত এবং হালনাগাদ রাখার সুযোগটা বেড়ে যাচ্ছে।
চলমান করোনার এ সময় আমরা দেখলাম বাসায় বসে কয়েক ধরণের কাজ করা যায়। যেমন, দেখছি কলসেন্টারের অনেককেই বাসায় বসে কাজ করতে বলা হচ্ছে। তার মানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও অনেক কল সেন্টার ৫০% কর্মীদের বাসায় বসে কাজ করতে বলতে পারে। এছাড়া, অনেক অফিসের সেলস-মার্কেটিংয়ের লোকেরা সকালে অফিসে জড়ো হয়ে তারপর যার যার কাজে যায়। কিন্তু এখন তারা সকালে বাসা থেকে ইন্সট্রাকশন পেলে আর অফিসে যাওয়ার দরকার পড়বে না। এ রকম নানা ধরণের পরিবর্তন হবে এবং কাজের বড় একটা অংশ বাসায় বসে করা যাবে। ডেটা বিশ্লেষণ, মার্কেট ফোরকাস্ট এসব করার জন্য ভাল একটা ইন্টারনেট সংযোগ অফিসে সশরীরে যাওয়ার থেকে বেশি কাজে লাগবে।
আমি একটা স্পেসিফিক উদাহরণ দিতে চাই। পৃথিবীতে দেড়শো কোটি ওয়েবসাইট আছে। এগুলোর অনেকগুলোই এখন নামকা ওয়াস্তে, রাখতে হয় বলে রাখা। কিন্তু এবার সবাই ওয়েবসাইটের গুরুত্ব বাড়িয়ে ফেলবে। এবং যাদের নেই তারাও ওয়েবসাইটে নজর দেবে। কাজে ওয়েবসাইট সংক্রান্ত কাজের পরিমাণ বাড়বে। বিশ্বে ই-কমার্সের ব্যপ্তি ও জনপ্রিয়তা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তাদেরও ওয়েবসাইট সুন্দর করতে হবে, প্রতিনিয়ত তথ্য হালনাগাদ করতে হবে, ওয়েবসাইটগুলোকে হ্যাকারের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। কোনো কোনো এলাকায় ড্রোনের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি হবে। সেগুলোকে কাউকে না কাউকে প্রোগ্রাম করতে হবে, চালাতে হবে। আবার ওয়েবসাইটকে কেন্দ্রে রেখে অনলাইন মার্কেটিং-এর সেবাও বাড়বে। সব মিলিয়ে শুধু ওয়েবসাইট কেন্দ্রিক কন্টেন্ট লেখা যাবে, প্রোগ্রাম শেখা যাবে, গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখা যাবে। অথচ এসব কাজ বাসায় বসেই করা যায়। কাজেই আমার ধারণা মেয়েরা যদি সত্যিকার অর্থেই কাজ করতে চায় তাহলে বাসায় বসে থেকেও এই কাজগুলো করার সুযোগ তারা নিতে পারবে। যদি তারা নিজেদের ঠিকঠাকমতো তৈরি করে নিতে এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের হালনাগাদ রাখতে পারে।
আবার মেয়েরা যদি তাদের ভাল না বোঝে তাহলে তাকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না। তবে কেউ যদি মনে করে, সে কিছু করতে চায় তাহলে আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া যে কিভাবে তারা কাজ করতে পারে। যেমন আমরা বিডিওএসএন থেকে মেয়েদের সুবিধার্থে নানাধরণের অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়েদের বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, তোমাদের সামনে একটা বিশাল জগৎ চাইলে তোমরা এটাকে জয় করতে পারো। আজ থেকে দুইশ বছর আগে অ্যাডা লাভলেস, ৬০-৫০ বছর আগে মার্গারিটা হ্যামিল্টন বা গ্রেস হপাররা এসব করে দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার পরপরই দেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজ বা জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহাদের দেখেও তারা অনুপ্রাণিত হতে পারে।
আজ ২৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে গার্লস ইন আইসিটি ডে। উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েদের বলা আইসিটি এমন একটা সেক্টর যেখানে তুমি সহজে ভাল করতে পারবে। শুধু তোমাকে নিজের চারদিকে তাকাতে হবে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা পিছিয়ে আছে যারা ভয় পায় তাদেরকে দেখানো যে, এ ক্ষেত্রে সফল নারীরাও তোমার মত স্কুলে-কলেজে গেছে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে যারা নিজেরাই এখন প্রতিষ্ঠান চালায়।
সব কথার শেষ কথা মেয়েকে তার নিজের জন্য নিজেকেই আগে জাগতে হবে। তা না হলে এগুনো সম্ভব নয়।
সবাইকে গার্লস ইন আইসিটি ডে-এর শুভেচ্ছা।