ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে যারা পড়েছেন তাদের কাছে লর্ড বায়রন খুবই পরিচিত একটা নাম। এছাড়াও ব্রিটিশ এই কবিকে চেনেননা এমন মানুষ খুব কম আছে। বায়রন একজন ব্রিটিশ কবি এবং রোম্যান্টিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তার বিখ্যাত কবিতা ডন জুয়ান অনেকেরই পছন্দের।
তবে, এখানে বায়রনকে নিয়ে লেখা উদ্দেশ্যে নয়। উদ্দেশ্য তার মেয়ে অ্যাডা লাভলেসকে নিয়ে যিনি বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার। অ্যাডা অগাস্টা কিং। যিনি অ্যাডা লাভলেস নামেই বেশি পরিচিত। অ্যাডা নামটি বাবা লর্ড বায়রনের দেওয়া।
ছোটবেলা থেকেই অ্যাডা কিছুটা অসুস্থতায় ভূগছিলেন, প্রচণ্ড মাথাব্যথা হতো এবং চোখে ঝাপসা দেখতেন। ১৮৩২ এ যখন তার বয়স ১৭ তখন তার বিশেষ গাণিতিক প্রতিভার লক্ষণ দেখা যায়। অ্যাডার ছেলেবেলা থেকেই মা তাকে গণিতে দক্ষ করে তুলতে চাইতেন যাতে বাবার প্রভাব কোনোভাবেই মেয়ের মধ্যে প্রতিফলিত না হয় এই ভেবে। ১৮৪১ সালের অ্যাডা জানতেনই না লর্ড বায়রন তার বাবা। বাসায় গৃহশিক্ষকেরা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন তাকে। গণিতজ্ঞ ও যুক্তিবিদ ডি-মরগ্যান তার শিক্ষক ছিলেন!। স্যার চার্লস ডিকেন্স, স্যার চার্লস হুইটস্টোন এবং বিজ্ঞানি মাইকেল ফ্যারাডে’র সাথেও তার জানাশোনা ছিল।
সে সময় ইংল্যান্ডে নারীশিক্ষার পথ একদমই সুগম ছিল না। তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ পেতেন। সে সূত্রে অ্যাডারও পড়ালেখার সুযোগ হয়। ১৭ বছর বয়সে তার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়া ঘটনাটি ঘটে। তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন কম্পিউটারের জনক বলে পরিচিত চার্লস ব্যাবেজ (যে পদে একসময় আইজ্যাক নিউটন অধ্যাপনা করেছেন)। তিনি জানতে পারেন যে, বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন কন্যা অ্যাডা বায়রন গণিতে সকল শিক্ষার্থীর চেয়ে সেরা। সে সময় তিনি ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ নিয়ে কাজ করছিলেন। মেধাবী অ্যাডাকে নিজের গবেষণার সহযোগী হিসেবে পেতে তিনি অ্যাডা ও তার মাকে আমন্ত্রণ জানান ডিফারেন্স ইঞ্জিন দেখার জন্য। এর মধ্যে ‘জ্যাকার্ড লুম’ নামক একটি বস্ত্রবুনন যন্ত্র অ্যাডার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়। এ যন্ত্রের কৌশলই তার ভবিষ্যৎ আবিষ্কারের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
জ্যাকার্ড লুম যন্ত্রটি পরিচালিত হতো একপ্রকার পাঞ্চকার্ডের মাধ্যমে। যন্ত্রে নির্দিষ্ট রকমের পাঞ্চকার্ড প্রবেশ করালে নির্দিষ্ট ধরনের বয়ন পরিচালিত হতো। এ ব্যাপারটিকে তিনি যন্ত্রের প্রতি নির্দেশনা তথা ‘মেশিন কোড’ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রোগ্রামিং এর ধারণা তখন থেকেই ঘুরতে থাকে পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামারের মাথায়। ব্যাবেজের সাথে কাজ করবার লোভ সংবরণ করে নিজেকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাডা।
১৮৩৫ সালে আর্ল অব লাভলেস, উইলিয়াম কিং কে বিয়ে করেন অ্যাডা বায়রন। সেই থেকে তার বায়রন প্রতিস্থাপিত হয় লাভলেস দ্বারা। ১৮৩৬-৩৯ সালের মধ্যে তার গর্ভে আসে ৩টি সন্তান। ঘন ঘন সন্তান জন্মদান এবং তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত অ্যাডার এ সময়টা কেটে যায় গাণিতিক জগতের বাইরে। কিন্তু, ডিফারেন্স ইঞ্জিনের প্রতি ঝোঁক দ্রুতই নিজের পুরনো ভালোবাসা গণিতের কাছে ফিরে আনে। তিনি গণিতের উচ্চতর শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করতে লাগলেন অবাধে। তার সময়কার অন্যতম সেরা গণিতবিদ সমারভিলের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে গণিত শেখার খাতিরেই। আর সমারভিলের হাত ধরেই তিনি জটিল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেন। এসব কাজের মাঝেও যে ব্যাপারটি তিনি কখনো ভোলেননি তা হচ্ছে ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন।
১৮৩৩ সালের ৫ জুন তার সাথে পরিচয় হলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত স্যার চার্লস ব্যাবেজর এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনকে কাজে লাগানোর জন্য'প্রোগ্রামিং'এর ধারনা দেন। ১৮৪২সালে ব্যাবেজ তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ইঞ্জিন সম্পর্কে ধারণা দেন। স্যার চার্লস উইলিয়াম ব্যাবেজ যখন তার ডিফারেন্স মেশিন বা এনালিটিক্যাল এঞ্জিন নামক কম্পিউটার আবিষ্কারের নেশায় মত্ত, তাঁর এই অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিনের ধ্যানধারণা যেই গুটিকয়েক মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অ্যাডা অন্যতম। অ্যাডা তার গণিতবিষয়ক বিশ্লেষণী ক্ষমতার দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন এই কম্পিউটারগুলোর নাম্বার ক্রাঞ্চিং এর অমিত সম্ভাবনা সম্পর্কে। তখনকার দিনে এই যন্ত্রটির কাজ ব্যাখ্যা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল এবং অনেক বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ তার চিন্তাধারাটিকে সমর্থন করেন নি। কিন্তু অ্যাডা যন্ত্রটির কার্যপদ্ধতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা দেন। ব্যাবেজ অ্যাডার ধীশক্তি, সাবলীলতা, প্রতিভা এবং গাণিতিক দক্ষতায় মুগ্ধ ছিলেন। ব্যাবেজ অ্যাডা সম্পর্কে তার লেখায় অ্যাডাকে সংখ্যার জাদুকরি (The Enchantress of Numbers) বলে আখ্যা দিয়েছেন তাঁর Decline of Science in England বইয়ে।
এই টেক-জিনিয়াস ১৮৫২ সালের ২৭ নভেম্বর, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অ্যাডার মৃত্যুর ১০০ বছর পর অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন সম্পর্কে তাঁর একটি নোট প্রকাশিত হয়। সেই নোটের G-নং এ তিনি Bernoulli numbers এর একটি সিকোয়েন্স ক্যালকুলেশন করার জন্য একটি অ্যালগরিদম বর্ণনা করেন যা পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম হিসেবেই পরিচিত। অ্যানালিটিকাল মেশিন (যা বর্তমান কম্পিউটারের পূর্বপুরুষ)-এর মত এই নোটটি ছিল মেশিনটির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এর বর্ণনা। আর এ কারণেই অ্যাডা অগাস্টা লাভলেস পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবেই পরিচিত। তাকে মর্যাদা দিতে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রমিত প্রোগ্রামিং ভাষার নাম রাখা হয় অ্যাডা (Ada)। কম্পিউটিং এবং প্রোগ্রামিং এ বিশেষ অবদানের কারণে ২৪ মার্চকে Ada Lovelace Day হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হয়ে থাকে।