বই পড়া আর লেখালেখি করা – এ দুটোই আমার খুব প্রিয় কাজ, কিন্তু কখনো ভাবি নি যে লেখালেখিকেই আমি নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারবো।
আমি পড়াশোনা করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এবং তারপর আমি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে দু’বছর চাকরি করি। ব্যক্তিগত কারণে কিছুদিন চাকরি ছেড়ে বাসায় থাকতে হয়, কিন্তু প্ল্যান ছিলো আবার কোনো একদিন চাকরিতেই ফিরে যাবো। তখনই আমি অনলাইনে কাজ করার কথা শুনি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। আমরা যে সময়ে কাজ শুরু করি তখন আসলে ‘ফ্রিল্যান্সিং’ শব্দটা এত জনপ্রিয় ছিলো না। এই ঘটনা ২০১৩ সালের, তখন আমি কাউকেই চিনতাম না যারা এই কাজ করে! তাই পরিচিত মানুষ না খুঁজে আমি গুগলের আশ্রয় নিলাম। গুগল থেকেই খুঁজে বের করলাম কোথায় কাজ পাওয়া যায়, কি কাজ করা যায়, কিভাবে প্রোফাইল বানানো যায়, কিভাবে কাজে এপ্লাই করা যায়।
আমি প্রোফাইল বানিয়ে কাজে এপ্লাই করার ৬ দিনের মাথায় আমার প্রথম কাজটি পেয়ে যাই, যেটা ছিলো ৫০ মিনিটের অডিও ট্রান্সক্রাইব করা। অর্থাৎ অডিও শুনে শুনে কথাগুলো লিখে যাওয়া। মাত্র ৫ ডলারের জন্য এই কাজটি করতে আমার সারা রাত লেগে যায়, কারণ আমার কাছে কোনো সফটওয়্যার বা অ্যাপ ছিলো না। কিন্তু আমার কাজ আমার প্রথম ক্লায়েন্টের খুব ভালো লাগে এবং সে আমাকে আরও অনেক কাজ দেয় এবং আমার রেট বাড়িয়ে দেয়।
ট্রান্সক্রিপশনের কাজ থেকে আমি আস্তে আস্তে আরটিক্যাল, ব্লগ, ওয়েবসাইট কন্টেন্ট আর ইবুক লেখার কাজ শুরু করি। তাছাড়া, আমি প্রডাক্ট রিভিউ, প্রডাক্টের বর্ণনা, ইকমার্স সাইটের জন্য কন্টেন্ট, নিউজলেটার কন্টেন্ট – এসবের কাজও করে থাকি। মার্কেটপ্লেসে ও বাইরে, দু-জায়গায় আমার বেশ কিছু ক্লায়েন্ট আছে। বিদেশি ক্লায়েন্ট বেশি থাকলেও, বাংলাদেশের বেশ কিছু ক্লায়েন্টের সাথে আমি সরাসরি কাজ করে থাকি।
২০১৫ সালে আমি বেসিস থেকে ‘ফিমেল ক্যাটাগরি’তে ‘বেসিস আউটসোর্সিং এ্যাওয়ার্ড’ পাই। একই বছরে আমি ‘ফ্রিল্যান্সার’স মিট এ্যাওয়ার্ড’ পাই ‘ফিমেল আউটসোর্সিং প্রফেশনাল’ হিসেবে। সবশেষে আমি বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশন আয়োজিত ‘ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স’ থেকে ‘বেস্ট ফ্রিল্যান্সার” এ্যাওয়ার্ড পাই।
বর্তমানে, আমার খুব ছোট একটি এজেন্সি আছে, ‘রাইটারস-অন-দি-ব্লক’। সোশাল মিডিয়া বা ই-মেইলে যারা আমার সাথে কাজ করতে আগ্রহ জানায়, তাদের আমি মার্কেটপ্লেসে একাউন্ট খুলতে সাহায্য করি, আর চেষ্টা করি আমার এজেন্সি’র মাধ্যেমে ২/৩টা ছোট ছোট কাজ যোগাড় করে দিতে। পরে তারা নিজেরাই নিজেদের কাজ খুঁজে নেয়। আমার সাথে অন্য যারা কাজ করে তারা মূলত স্টুডেন্ট বা হোমমেকার। তারা নিজেরা একাউন্ট করার বা কাজ খুঁজে নেবার সময় পায় না। আমি যদি বড় কোনো কাজ পাই, তাদেরকে দিয়ে করিয়ে নেই। এতে তাদের নিজেদের কিছু বাড়তি আয় হয়।
কাজ পেতে আমার তেমন কোনো সমস্যা হয় না, এটা সত্যি। আমার কষ্ট হয়েছে একজন বাংলা ভাষার মানুষ হয়ে ইংরেজি লেখায় নিজের রেট বাড়াতে। মাঝে আমি নিজের কাজের রেট নিয়ে এত হতাশ হয়ে পরেছিলাম যে আমি কিছুদিন কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছিলাম। এই সময়টা আমি কাজে লাগিয়েছিলাম বিভিন্ন ধরনের স্যাম্পল বা পোর্টফলিও তৈরি করতে। যে সব টপিকে ক্লায়েন্ট লেখা চায়, সেসব টপিক নিয়ে আমি বেশ কিছু আর্টিকেল লিখে রেখেছিলাম। এমন কি, আমি ৩/৪টা ব্লগ সাইটও তৈরি করেছিলা আমার নামে। আমি সারাজীবনে যা যা লিখেছি, সব ঠিক করে রেডি করে রেখেছিলাম। এরপর থেকে, যখনই কোনো কাজে অ্যাপ্লাই করতাম, দেখানোর জন্য স্যাম্পল আমার তৈরি করাই থাকতো।
নতুন যারা অনলাইনে কাজ করতে চায় বা মার্কেটপ্লেসে আসতে চায় অথবা লেখালেখির কাজ করতে চায় তাদের আমি বলবো, সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আসবেন। বাংলাদেশে থেকে বাংলা ভাষি হয়ে লেখালেখির কাজ পাওয়া খুব কঠিন কাজ, বিশেষ করে এই সময়ে। আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনি অসম্ভব ভাল লিখতে পারেন এবং আপনার লেখাতে কোনো রকম ব্যাকরণগত ভুল নেই। শুধু তাই না, আপনার লেখা হতে হবে অনেক তথ্যপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও মজার। আপনার লেখা একটি বই যদি কেউ না কেনে, ক্লায়েন্ট আপনাকে কাজ দেবে না। আপনার লেখা প্রোডাক্ট রিভিউ পড়ে যদি কেউ প্রডাক্ট না কেনে, আপনি কাজ পাবেন না। একজন ক্লায়েন্ট আপনার কাছে ঘুরে ফিরে বারবার আসবে যখন আপনার লেখার মান তার ব্যবসাকে উন্নত করতে পারছে।
-অজন্তা রেজওয়ানা মির্জা