Blog & News

Official blog of Bangladesh Open Source Network

তোমার নিরাপত্তা তোমার হাতেই থাকুক

তোমার নিরাপত্তা তোমার হাতেই থাকুক

২৫ নভেম্বর— ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’। ঠিক কবে থেকে নারীদের উপর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা সর্বোপরি সামাজিকভাবে সহিংসতা শুরু হয়েছে তার কোনো সঠিক দিনক্ষণ জানা না থাকলেও, নারীদের প্রতি সহিংসতার হিংস্রতা দিনে দিনে পুরো মানবজাতির জন্য অমর্যাদাকর ও অবমাননাকর পর্যায়ে চলে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর এই দ্বারপ্রান্তে এসে যখন আমরা সভ্যতা আর উন্নত বিশ্বের মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা নিয়ে গর্ব করছি, তখনও দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী পুরুষের তুলনায় মেয়েরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রার সর্বত্র পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পাল্টায়নি নারী নির্যাতনের চিত্র। নারী— এই শব্দটি যেন সেই প্রাচীনকাল থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এখনো নারীকে পারিবারিক, সামাজিক বা অধিকারের দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষ তো বিবেচনা করা হয়ই না, বরং প্রতিনিয়ত নারীকে লড়তে হয় তার স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। অথচ এই নারীর কারণেই একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়, একটি সুন্দর জীবনের শুভ সূচনা হয়। আর এই নারীকেই মানুষ নয়, আমাদের এই সমাজে কেবলমাত্র একজন নারী হিসেবে চিহ্নিত।

পরিবার থেকে রাষ্ট্র বিশ্বের কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। ঘরে, ঘরের বাইরে, রাস্তাঘাট, যানবাহন, কর্মক্ষেত্রে এবং এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সর্বত্রই নারীরা নিরাপত্তাহীন। এমনকি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দায়িত্বরত পুলিশবাহিনী দ্বারাও সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী— এমন নজিরও আছে আমাদের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে। প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে একজন তার স্বামীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। পারিবারিক নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে ২৮তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যে ধরনগুলো সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়, সেগুলো হলো যৌতুকের জন্য সহিংসতা, এসিড আক্রমণ, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, জখম এবং পাচার। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র :

সাল  সহিংসতার শিকার
২০০১ ১২৯৫৮ জন
২০০২ ১৮৪৩১ জন
২০০৩ ২০২৭৮ জন
২০০৪ ১২৮২৫ জন
২০০৫ ১১৪৫৬ জন
২০০৬ ১১০৭৯ জন
২০০৭ ১৪২৯০ জন
২০০৮ ১৪৩৩১ জন
২০০৯ ১২৯২৭ জন
২০১০ ১৬৩৫৩ জন
২০১১ ১৯৮৮৯ জন
২০১২ ১০০২৯ জন

 

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ জানুয়ারি থেকে ২০১২ জুন পর্যন্ত মোট এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৫০ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে যৌতুকের জন্য সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫১ হাজার ৯৫৭ জন, অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন এক হাজার ৮৮৩ জন, ধর্ষণ ৩৮ হাজার ৭৯১ জন, খুন এক হাজার ৪৯৭ জন, পাচার হয়েছেন ৯৫৯ জন ও অন্যান্য ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৮ হাজার ৪৩৪ জন। অন্যদিকে, মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৭৭৭টি।

২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দফতরে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা পর্যালোচনার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ১৯ হাজার ৬০১টি মামলা হলেও নভেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ১১ মাসে ১৯ হাজার ৭৭৩টি মামলা রেকর্ড হয়েছে, যা অন্তত ১০ শতাংশ মামলা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া শুধু ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারেই দুই হাজার ৩৫১টি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়।

২০১৬ সালে ৫৫টি জেলায় ও ৩৭৯টি উপজেলায় নির্যাতনের শিকার নারীদের তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্র্যাক একটি জরিপ চালায়। নথিভুক্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, মোট নির্যাতনের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের হার ৬৭ শতাংশ, যৌন নির্যাতনের হার ১৯ শতাংশ এবং মানসিক নির্যাতনের হার ১৪ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে শারীরিক নির্যাতন এবং শিশুদের মধ্যে যৌন নির্যাতন। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১.৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার।

এতো বেশি সংখ্যক নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ আইনের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেক কমসংখ্যক নারী। এর কারণ হিসেবে নারীরা বলেছেন, কেউ কেউ স্বামী বা পরিবারের ভয়ে, কেউ হয়তো অভিযোগ করাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে, কেউ সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, নিজের সম্মান ও পরিবারের কথা চিন্তা করে তারা আইনের আশ্রয় নেন না।

এ তো গেলো কেবল শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের বিষয়। এর বাইরেও সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনেও নারীদের প্রতি সহিংসতার সংখ্যাও বাড়ছে। অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও এই সংখ্যা এমনই। এসব নারীর মধ্যে বেশিরভাগ যৌন হয়রানি, হ্যাকিং, সাইবার পর্নোগ্রাফি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হন। এসব অভিযোগের মধ্যে হ্যাকিং ২০ শতাংশ, ফেক আইডি ২০ শতাংশ, হয়রানি/মানহানি ১৮ শতাংশ, সাইবার পর্নোগ্রাফি ১৪ শতাংশ, মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা ১৪ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইল/চাঁদাবাজি ৭ শতাংশ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ১ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ।

দক্ষিণ আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল নামে তিন বোনকে হত্যা করা হয়। নারীর উপর এই নির্যাতন সারাবিশ্বে, বিশেষ করে নারী সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৮১ সালে ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার নারীদের এক সম্মলনে এই দিন কে “নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এই দিনটি স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং পাশাপাশি ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশেও প্রতিবছরের মতো এই ১৬ দিনকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস পক্ষ হিসেবে পালন করে আসছে “টেইক ব্যাক দা টেক”। এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্রচারণা অভিযানের অংশ যা নারীদের বিরুদ্ধে প্রযুক্তির সহায়তার বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে এবং তার সমাধানে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে নারী সহিংসতা বিশেষ করে অনলাইনে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কাজ করে আসছে “টেইক ব্যাক দা টেক”।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, অনলাইনে আগ্রাসী আচরণ, নিপীড়ন, অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার, পরিবর্তিত ছবি ব্যবহার করার ৯৫ শতাংশ ঘটনায় হয় মেয়েদের বিরুদ্ধে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষবন্ধু বা তার প্রাক্তন স্বামীরা এই কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। পুরুষ বা মহিলারা উভয়েই অনলাইনে বদমাইশদের নজরদারীতে থাকে। তবে, ১৮-৩২ বছর বয়সীদের বেলায় নজরদারীতে মেয়েরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন মেয়েরা আগ্রাসী আচরণের শিকার হচ্ছে তেমনি একটু সচেতন হলেই এই আগ্রাসী মনোভাব থেকে মেয়েদের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর সেই জন্য ছেলেমেয়ে উভয়ের মধ্যে দরকার সচেতনতা। তবে মেয়েদেরই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রযুক্তির যে খারাপ দিকগুলো একটা ছেলে বা পুরুষ খারাপভাবে ব্যবহার করতে পারে, প্রথমেই একটা মেয়েকে জেনে নিতে হবে সেই কলাকৌশল। মোটেও কঠিন কোন কাজ নয় তা। একটু সচেতন আর চেষ্টাতেই সেটা সম্ভব। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হলে নারী সম্পর্কে চিরাচরিত ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে, নারী নেতৃত্বের উদাহরণ তৈরি করতে হবে, যা নারীর প্রতি সমাজের তথাকথিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনবে। লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হলে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরির জন্য শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিক্ষা উপকরণ, যেমন বইগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা থেকে ছেলে বা মেয়ে কেউই কোনো একটি জেন্ডারের প্রতি পক্ষপাত নিয়ে বড় হতে না পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, বাবা-মাকে পরিবারের মধ্যে এমন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যা দেখে সন্তানেরা বাবা-মায়ের সমঅধিকার, সমান দায়িত্ব, বিষয়গুলো দেখবে ও শিখবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। সব পেশার মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ভূমিকা রয়েছে। পেশাগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা—দুটো বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৪ সাল থেকে “টেইক ব্যাক দা টেক-বাংলাদেশ” সেই কাজটিই করে যাবার চেষ্টা করছে। ‘টেইকব্যাক দ্য টেক’ অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তথ্য ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া আন্তর্জাতিক একটি প্রচারাভিযান।

“টেইক ব্যাক দা টেক-বাংলাদেশ” স্বপ্ন দেখে এবং বিশ্বাস করে এখনকার যুব সমাজকে নিয়ে একদিন বাংলাদেশও পারবে নারী সহিংসতা বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে তার মান রাখতে।

 

মাহবুবা সুলতানা, সমন্বয়ক, টেইক ব্যাক দা টেক-বাংলাদেশ