বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক টেকনোলজি ওয়ার্ল্ডে তিনি পরিচিত একটি নাম। বিশ্বের নামকরা জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করার পর তিনি এখন নিজের দেশেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যেখান থেকে তিনি তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক-বিডিওএসএনের মিট দ্য লিডার অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন সোনিয়া বশির কবির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিওএসএনের হেড অব অপারেশন জাহানারা আমির জিমি।
বিডিওএসএন: আপনি খেলোয়াড় ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করেছেন ব্যবসা প্রশাসনে কিন্তু ক্যারিয়ার গড়েছেন টেকনোলজি নিয়ে। কেউ যদি আপনাকে ফলো করতে যায় সেত এমন স্টেপ বাই স্টেপ পরিবর্তন দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে?
সোনিয়া বশির: আমি ছোট বেলা থেকেই সব কিছুতে চ্যালেঞ্জ নিতে শিখেছি এবং এটা আমার পছন্দ। একটি সেক্টরে দীর্ঘদিন কাজ করলে সেখানে রিলাক্সেশন চলে আসে। তাই নতুন কিছু শুরু করা বা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার চেষ্টা করি। তবে, আমাদের সমাজের একটা কমন ধারনা হচ্ছে শান্তি পূর্ণ ক্যারিয়ার বাছাই করা। কিন্তু এই শান্তি পূর্ণ ক্যারিয়ার মানুষকে বড় কোন স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিতে পারে না। লাইফে বড় কিছু করতে হলে স্বপ্নটাকে বড় করতে হয় ও নতুন নতুন চ্যলেঞ্জ নিতে হয়। আমি ছোট বেলায় খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম, যখন সিলিকন ভ্যালিতে ছিলাম তখন সেখাকার টেকনিকাল পরিবেশটার সাথে নিজেকে এডজাস্ট করি। পড়াশুনার ক্ষেত্রে বিজনেস সেক্টর থেকে টেকনিক্যাল সেক্টরে মুভ করি। আমাদের দেশে হয়ত সেই সুযোগ নেই। কিন্তু আমি মেয়েদের বলব নিজের স্বপ্নটাকে এগিয়ে নেন ও টেকনিক্যালি আডভান্স হোন।
বিডিওএসএন: মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানকে না বলে দিয়ে নিজের দেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাহলে কি ব্যক্তি সোনিয়া বশির কবির প্রতিষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে?
সোনিয়া বশির: এটাকে অনেকটা এরকমই বলতে পারেন। তাছাড়া, দীর্ঘ দিন মাইক্রোসফট এর সাথে যুক্ত থেকে একটা সময় নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়েছে। আমেরিকার মত দেশগুলোর সফটওয়ার প্রোডাক্ট নিজের দেশে বিক্রি করার চেয়ে নিজের দেশে নতুন নতুন বিজনেস সেক্টরগুলোকে এগিয়ে নেওয়া ও দেশীয় প্রযুক্তিতে কিছু তৈরি করা নেওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাই আমি এত বড় একটা প্লাটফর্ম ছেড়ে ভিন্ন কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করার চ্যলেঞ্জ নিয়েছি।
বিডিওএসএন: যে স্বপ্ন নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তার উদ্দেশ্য কি?
সোনিয়া বশির: সিলিকন ভ্যালিতে আমি দেখেছি কিভাবে বড় বড় মিলিওনিয়ার কোম্পানিগুলো ছোট ছোট স্টার্টআপ গুলোতে ফান্ডিং করে। আমিও আমার দেশের ভাল ভাল স্টার্টআপ গুলোর জন্য ফান্ডিং সংগ্রহ করতে চাই ও বিশ্বকে দেখাতে চাই আমাদের দেশেও ভাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা সম্ভব। আমি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো স্টার্ট আপে ফান্ডিং করার ক্ষেত্রে ভাল প্রজেক্ট বা আইডিয়া থেকে টিম বিল্ডিং এর দিকে ফোকাস করি। একটি ভাল টিম থাকলে ও রিস্ক নেওয়ার যোগ্যতা থাকলে তারা কাজের মাধ্যমে অনেক দুরে এগিয়ে যেতে পারে।
বিডিওএসএন: আমাদের দেশের ছেলে মেয়েদের চাকরি কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা থেকে বের হওয়ার উপায় কি?
সোনিয়া বশির: আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের সবার মেন্টালিটি এক না। কেউ রিস্ক নিতে পারে কেউ পারে না। এক্ষেত্রে যাদের রিস্ক নিয়ে বিজনেস করার মেন্টালিটি আছে তাদের আমি বলব সবাই একটা ভাল আইডিয়া নিয়ে গ্রুপ করে কাজ করেন। সাথে অভিজ্ঞ যারা আছেন তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমাদের দেশে যেহেতু ভাল ফান্ডিং করার মত মিলিওনিয়ার কোম্পানি নাই তাই সীমিত পরিসরে ভাল আউটপুট আনার চেষ্টা করতে হবে। তবে এখন অনেকেই স্টার্ট আপ করতে চায়। তাদের জন্য বলব, শুরুতে একটা চাকরি কর, অভিজ্ঞতা নাও তারপর ঠিক কি করতে চাও সেটার ফোকাস ঠিক করো। ভালভাবে বুঝে আইডিয়া ঠিক করে, পুরো প্ল্যানিং গুছিয়ে নিয়ে তারপর স্টার্ট আপের ফান্ডিংয়ের দিকে আগাও।
বিডিওএসএন: আপনি আপনার বিভিন্ন বক্তব্যে ছেলেমেয়েদের ইন্টারপ্রেনার হওয়ার থেকে ইম্প্যাক্ট প্রেনার হওয়ার পরামর্শ দেন কেন?
সোনিয়া বশির: ইন্টারপ্রেনার তো অনেকেই হতে পারে কিন্তু ইম্প্যাক্ট প্রেনার হতে কোনো নির্দিষ্ট সমস্যাকে কার্যকর ভাবে সমাধান করতে হয়। আমাদের দেশে যেহেতু সমস্যা অনেক বেশি তাই সমাধানের রাস্তা খোঁজার সুযোগও বেশি। তাই দেখা যায় বাইরের দেশের লোকও আমাদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। আমাদেরও তাই এই বিষয়টাতে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি।
বিডিওএসএন: রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের বাইরে যেখানে বিদ্যুৎ বা প্রযুক্তি ব্যবহার খুবই অপ্রতুল সেখানে স্থানীয় মেয়েরা কিভাবে এগিয়ে যেতে পারে?
সোনিয়া বশির: ভাল ইনোভেশনের জন্য ইন্টারনেট ও কারেন্ট এর সুবিধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ না। শুধু আইডিয়া টাই আসল এইখানে। এইজন্য কিভাবে ভাল ওয়েতে নেটওয়ার্ক কানেকশন আরও স্ট্রং করা যায় সেই রকম আইডিয়া নিয়েই কিন্তু সবাই কাজ করতে পারে।
বিডিওএসএন: বর্তমানে মেয়েরা ক্যারিয়ারের কথা ভেবে বিয়ে বা সংসার করতে দেরি করে সেক্ষেত্রে আপনি অনার্সের আগেই বিয়ে করে পড়াশুনা সংসার ও ক্যারিয়ার কিভাবে ঠিক রাখলেন?
সোনিয়া বশির: আমি ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম একজন মা হব, উচ্চ শিক্ষা অর্জন করব এবং চাকরি করব। এ কারণেই এইচএসসি পাশের পর যখন বিয়ে হয় তখন আমি বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় অনার্স করি। মাস্টার্সও কমপ্লিট করি সাথে চাকরি ও সংসার সমানতালে ঠিক রেখেছি। আমার কাছে কোনোটাই প্রেশার মনে হয় নি। এবং এখনো আমি আমার স্বপ্ন পুরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
বিডিওএসএন: বর্তমানে টেকনোলজিক্যাল সেক্টরে মেয়েদের অংশগ্রহণ মাত্র ৩০%, অনেক মেয়েরাই ফ্যামেলির প্রেশারে ভাল সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশুনা করে, কিন্তু চাকুরী ক্ষেত্রে বা ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ তেমন দেখা যায় না কেন?
সোনিয়া বশির: আমি মনে করি এক্ষেত্রে আমাদের মেয়েদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে সঠিক চিন্তাভাবনার অভাব আছে। আমাদের সমাজ এখানে তাদের যে চিন্তা দেয় তারা কোনো অ্যানালাইসিস ছাড়াই তাতে অভ্যস্ত হয়ে পরে। এই অবস্থা থেকে উঠতে হলে তাদের মধ্যে সেলফ রিফ্লেকশনের চর্চা করতে হবে। তাদের জীবনের লক্ষ্য কি বা তারা কি করতে চায় তা ঠিক করতে হবে। তাদের ভিতর থেকে এই ব্যাপারটা জাগাতে হবে। কাজের প্রতি কিউরিসিটি থাকতে হবে, স্বপ্ন কে বড় করতে হবে ও বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস থাকতে হবে। এভাবেই সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
বিডিওএসএন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের স্টুডিওতে আসার জন্য।
সোনিয়া বশির: আপনাকেও ধন্যবাদ।