নিজের ব্যবসায়িক উদ্যোগ কে সাথে নিয়ে যখন পথ চলা শুরু হয় তখনো উদ্যোক্তা শব্দের মানে জানতেননা মাকসুদা খাতুন। নিজের প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। একদম শূন্য শুরু করে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজ অনেকের কাছে একটি পরিচিত মুখ মাকসুদা খাতুন। ২০১৬ সালে চামড়াজাত পণ্য নিয়ে যে উদ্যোগ তিনি শুরু করেন, ধীরে ধীরে তা এখন সাফল্যের মুখ দেখছে। মোট ৩৫ জন কর্মীর সাহায্যে নিজেদের তৈরী চামড়াজাত পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের একটি প্ল্যাটফর্ম ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো’ এর উদ্যোগে আয়োজিত ই-উদ্যোক্তা হাট ২০২০ এ অংশগ্রহণকারী এই নারী শোনান উদ্যোক্তা হিসেবে তার পরিচিতি পাওয়ার গল্প।
একাউন্টিং এ স্নাতক ও স্নাতকত্তোর সহ ফাইনান্সে এমবিএ করার পর চাকরি করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কখনো শিক্ষকতা পেশায় কিংবা কখনো একাউন্টেন্ট হিসেবে বায়িং হাউসে। কিন্তু চাকরির চেয়ে নিজে কিছু করার তাগিদ টেনেছিল তাকে বেশী। সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বামীর মুখ থুবড়ে পড়া ব্যবসায় হাত লাগানোর চিন্তা থেকে দুজন মিলে তৈরী করেন ‘শাবাব লেদার’। শুরু হয় তার ব্যবসায়িক জীবন।
চাকরি জীবন নাকি উদ্যোক্তা জীবন- কোনটা বেশী টানে এমন প্রশ্নে মাকসুদা জানান, চাকরি জীবনের সেই ৯টা-৫টার গৎবাঁধা জীবনে নিজের জন্য করা হয়না কিছুই। কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব সামলে নিজের দক্ষতার পরিচর্যা করার ফুরসত মেলেনা একেবারেই। তবুও খুব চেষ্টায় নিজের জন্য কিছু করা গেলেও সমাজের প্রতি যে দায়বদ্ধতা তার কাছে নিজেকে পরাজিত মনে হত। আজ উদ্যোক্তা হিসেবে আমি নিজের ভালো লাগার জায়গাটাকে যেমন পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি তেমনি অনেক পরিবারের জন্য সাহায্যের জায়গাও তৈরী করতে পেরেছি। আজকে আমার এই শাবাব লেদারের কারণে ৩০-৩৫ জন কর্মী এবং তাদের পরিবার নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে, ভালো করে বাঁচতে পারছে। এখানেই তো একজন উদ্যোক্তার সফলতা, যার মধ্য দিয়ে মানবিক দায়িত্বটুকুও পালন করা সম্ভব। তাই সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাকে আর কিছু টানেনা।
চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো গ্রুপের পরিচিত মুখ মাকসুদা খাতুন তার ব্যবসায়িক জীবনে এই গ্রুপের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন ফেসবুক ভিত্তিক এই গ্রুপের মাধ্যমে তিনি প্রথম কোন আঞ্চলিক পর্যায়ে মেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান। এছাড়া এই গ্রুপের মাধ্যমে সারাদেশে শাবাব লেদারের যে পরিচিত তৈরী হয়েছে তা ধরে রাখার খুব কার্যকরি একটি অবদান ছিলো বিডিওএসএন এবং ইএসডিজি প্রকল্পের তিনদিনের ইনোভেশন বুটকক্যাম্প যেখানে শুধু পরিচিতি নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্যোক্তাদের খুব কাছে থেকে শেখার সুযোগ হয়েছে। দুই বাচ্চা ও ব্যবসা রেখে ৩ দিনের ক্যাম্প এর জন্য সময় বের করাটা যদিওবা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো, তারপরেও উদ্যোক্তা হিসেবে এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনদিনের জন্য যোগ দেন সারা দেশের ৩০ জন নারীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত গার্লস ইনোভেশন বুটক্যাম্প-এ। ছন্নছাড়া জীবনের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে সুশৃঙ্খল তিনদিন রুটিন মাফিক চলা, প্রতিভাবান সফল উদ্যোক্তাদের শিক্ষামুলক সেশন ও পরামর্শ নেয়া,সেই সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পাওয়া অসাধারণ ভালোবাসায় সিক্ত মাকসুদা খাতুন তার অভিজ্ঞতার বর্ণণা দেন রিক্তচিত্তে। তিনি জানান, এই ক্যাম্পে একসাথে আমরা প্রায় ৩০ জন উদ্যোক্তা একই ছাদের নীচে তিনটি দিন পার করেছি। তাদের মাঝে ছিলো উদ্যোক্তা, হবু উদ্যোক্তা, ডাক্তার, প্রকৌশলীয় সহ অনেক শিক্ষার্থী যারা আমারই মত উদ্যোক্তা হতে চায়। এই আনন্দময় অভিজ্ঞতা বর্ণনাতীত। একে অপরের কাছে এতো শেখার সুযোগ এবং সহযোগিতা পেয়েছি যে নিজের প্রতি বিশ্বাস হাজারগুণ বেড়ে গেছে।
ক্যাম্প থেকে নিজের উদ্যোগের জন্য কি অর্জন করেছেন জানতে চাইলে মাকসুদা জানান, তিনদিন জুড়ে বিভিন্ন আইডিয়া, বিজনেস মডেল ক্যানভাস তৈরী, আইডিয়া পিচিং ছাড়াও যে সেশনগুলো আমাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল সেগুলো থেকে আমরা নানা সমস্যা সমাধানের পথের খোঁজে পেয়েছি! চলেছে অনেক আড্ডা, গল্প, পরিচয় সেই সাথে হয়েছে অনেক প্রোফেশনালদের সাথে নেটওয়ার্কিং এর সুযোগ যেটা আমাদের মত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য একটা পরম পাওয়া! আমার ক্ষেত্রে এটা ছিলো অন্যদের চেয়ে আরও বেশি উপযোগি , কারণ সেখান থেকে যেই নেটওয়ার্ক, টিমওয়ার্ক, রুটিন মাফিক চলা, বিজনেস মডেল এর আইডিয়া গুলো পেয়েছি তা আমার ব্যবসায়িক কাজে আরোও অনেক বেশি কার্যকরি ভুমিকা রাখছে। সেই সাথে বোনাস হিসেবে ছিলো সারা দেশের উদ্যোক্তাদের সাথে নেটওয়ার্কিং ও অভিজ্ঞদের পরামর্শ কেননা গেস্ট, স্পিকার প্রত্যেকেই আমার জন্য নতুন অনুপ্রেরণার এক একটা মডেল। আর শুধু মাত্র সেশন ই ছিলো না, আমরা এত মজা করতাম যে সারা দিন এর সেশন এর পরেও গল্প,আড্ডা ও গান এর মাঝে রাতে আমরা ঘুমানোর কথা ভুলেই যেতাম। আসলে আমার জীবনের অন্যরকম অসাধারণ ৩ টা দিন এতটা হবে চমৎকার আশা করি নি।
করোনার এই ক্রান্তিকালে ব্যবসা কতটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে জানতে চাইলে মাকসুদা খাতুন জানান এই সময় প্রায় অনেকগুলো অর্ডার বন্ধ ছিলো। লকডাউনের কারণে নির্ধারিত সময় ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিতে না পারলেও সীমিত সময়ের জন্য যখনি লকডাউন শিথিল করা হয়েছে তখনি সুরক্ষা নীতি মেনে ১০/১৫ জন কর্মী দিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। পণ্যের গুণগত মানের সাথে আপোষ না করায় এবং এই কঠিন সময়েও বেশ অনেকটা কাজ এগিয়ে নেয়ায় ক্রেতা আরো কিছু সময় দিতে রাজি হয়েছেন এবং সেখানেও বিশ্বস্ততার সাথে বেশ বড় একটা আয় করতে পেরেছেন।
এই ক্রান্তিকালে ই-উদ্যোক্তা হাট বেশ ভালো একটি সুযোগ এনে দিয়েছে জানিয়ে মাকসুদা বলেন, করোনা বেশ খানিকটা ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে ফেললেও নতুন সম্ভাবনা দেখিয়ে গেছে আমাদের। হোলসেলার হিসেবে আগে আমরা অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায় খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। সেকারণে প্রযুক্তির প্রায় অনেকগুলো দরজাই আমাদের কাছে অচেনা ছিলো। এখন সেখানে করোনার কারণে আমাকে ব্যবসার ধারাবাহিকতা রাখতে অনলাইনের প্রতি ঝুঁকতে হয়। ই-উদ্যোক্তা হাটের মাধ্যমে নিজের পণ্যের প্রচারণা করতে পেরেছি এবং সেখানে সারা দেশ থেকে অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন। এছাড়াও ব্যবসার ফেসবুক পেজে বুস্টেড প্রচারণাগুলোও অনেক সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি নতুন অনলাইন ই-কমার্স সাইট চালু করারও সিদ্ধান্তও নিয়েছি আমরা। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনের মাস থেকে নতুন এই ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে দৈনিক সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু করব আশা করি। নতুন কাজে হাত দেয়ার ক্ষেত্রে ইনোভেশন ক্যাম্পের বিজনেস প্ল্যানের ধারণা আমাকে অনেকটাই সহযোগিতা করবে। এছাড়াও চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো গ্রুপের আমাদের বিশাল পরিবার তো সাথেই আছে।
আত্মবিশ্বাসী মাকসুদা খাতুন জানান, চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো গ্রুপের উদ্যোক্তা হাট, উদ্যোক্তা সম্মাননা, উদ্যোক্তা মেলা, বিডিওএসএন এর ইনোভেশন বুটক্যাম্প ইত্যাদি আমাকে ব্যবসায় অনেকটাই সাবলিল হতে সাহায্য করেছে। ফন্ডিং, ব্যাংক লোন ইত্যাদির জন্য আবেদন করতে আগে সাহস পেতাম না। এছাড়া আগে মনে হত আমি শুধু ব্যবসাটাই করি, সকলের সামনে কথা বলার কাজটা অন্যকে দিয়ে করাবো। সেখানে এইসব প্ল্যাটফর্মের কারণে সুন্দর উপস্থাপনের কাজটা এখন আমি নিজেই করতে পারি যেটা ফান্ডিং কিংবা ব্যাঙ্ক লোন পেতে খুব জরুরি। ইনোভেশন বুটক্যাম্পে আইডিয়া পিচিং এর মাধ্যমে কথা বলার জড়তা অনেকটাই কাটিয়ে এখন আমি ই-উদ্যোক্তা হাটে নিজের পণ্য উপস্থাপন করছি। এটা অনেক বড় একটা প্রাপ্তি।
আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী উদ্যোক্তা স্বপ্ন দেখেন একদিন নিজের প্রতিষ্ঠানে তৈরী হবে আরো অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। সেই সাথে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে শাবাব লেদার-এর সুনাম। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মাকসুদা বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য বর্তমানে সুযোগগুলো অনেক প্রশস্ত যেটা আমাদের সময় ছিলো না। ছিলোনা এমন নির্দেশনা দেয়ার মত প্ল্যাটফর্ম। তাই তাদের জন্য উদ্যোগ নিয়ে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছনো টা অনেক সহজ। কিন্তু তাই বলে কোন শর্টকাট পথে হাটা উচিত না। ব্যবসা কখনো শর্টকাটে সম্ভব নয়। এখানে বাজার চাহিদা, দরদাম, প্রতিযোগী সংস্থা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে তবেই নামতে হয়। তাই এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে মেয়েদের উদ্যোক্তা হবার আহবান জানাই।
ব্যর্থতা থেকে যে উদ্যোগের শুরু করেছিলেন মাকসুদা খাতুন, আজ সেই উদ্যোগের লোগো ই-উদ্যোক্তা হাটের মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় দেখতে পেরে উচ্ছসিত তিনি। তিনি বলেন, ব্যর্থতা নতুন পথের সন্ধান দেয়। যেসব ভুলের কারণে আমাদের একটি ব্যবসা আলোর মুখ দেখতে পারেনি, ঠিক সেই ভুলগুলো শুধরে নেয়ার কারণেই আজ আমাদের শাবাব লেদার একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে গড়ে উঠছে। চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো গ্রুপ এবং বিডিওএসএন এর মত প্ল্যাটফর্ম পেলে এরপর যেকোন ভুল করার আগেই সচেতন হয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই শুধু সফলতার গল্প নয়, কখনো কখনো ব্যর্থতার গল্প ও সফল হতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
মাকসুদা খাতুন মনে করেন মানুষ মাত্রই সৃজনশীল। এর সঠিক পরিচর্যা এনে দিতে পারে একটি সফল উদ্যোগের। তাই নিজের আশেপাশে যত ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে তার সঠিক সদ্বব্যবহারে মাধ্যেমে নারীদের উচিত নিজের সৃজনশীলতার কে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পাশাপাশি সমাজের আর দশজনের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
উল্লেখ্য, আত্মকর্মসংস্থানে তরুণদের অনুপ্রাণিত করার প্ল্যাটফর্ম ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’র উদ্যোগে ১৭ জুলাই ২০২০ থেকে অনলাইনে ই-উদ্যোক্তা হাট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলবে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। তরুণ উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবা যৌথভাবে অনলাইনে ত্রেতাদের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে করোনার কারণে বিপর্যস্ত উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ। http://uddoktahaat.com ওয়েব ঠিকানায় মোট ৩২টি প্রতিষ্ঠান এর সাথে আছে মাকসুদা খাতুনের চামড়াজাত পণ্যের উদ্যোগ শাবাব লেদার। ।