Blog & News

Official blog of Bangladesh Open Source Network

কোভিড-১৯: বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার পথে

কোভিড-১৯ মহামারিতে প্রতিটি খাতের ভয়াবহতা দৃশ্যমান। তারই একটি দিক হচ্ছে, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা। এই ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে বলা হচ্ছে, কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত, বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে রয়েছে।

কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার ওপর সাম্প্রতিক একটি জরিপ শেষে ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিশ্বব্যাংক তাদের মূল্যায়নে বলছে, চলমান কোভিডের কারনে এই সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তাদের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন বা সার্টিফিকেট দেওয়ার কাজ অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে।

wysd 2020

এইরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশে এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। তাই এই শিক্ষাকে যদি ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষনীয় করা যেত তাহলে করোনার এই চলমান সময়ে কর্মসংস্থান নিয়ে এত ভাবতে হতো না।

গত কয়েকদিনে নীতিনির্ধারক, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানের প্রধান বা দাতা সহযোগিরা এই খাতের নানা দুর্বলতার কথা স্বীকার করছেন। তারা বলছেন, ছেলেমেয়েদের কাছে এই শিক্ষাকে আকৃষ্ট করতে না পারা, সারাদেশের সঙ্গে সঠিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারা। ব্যবহারিক উপকরণের তীব্র ঘাটতি, কোর্স কারিকুলাম আধুনিক না হওয়া বা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাই আজকের এই সংকটের মূল। অথচ এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দিলে আজকের এই দুঃসময়ে কর্মসংস্থানের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হওয়া অনেক সহজ ছিল।

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক-বিডিওএসএন যুব দক্ষতা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছে। এরইমধ্যে একজন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিরেক্টর অব প্ল্যানিং মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, বর্তমানে ডিপ্লোমা ইঙ্গিনিয়ারিংয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ৩ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী আছে। তাছাড়া বিজনেস স্পেশালাইজেশন সেক্টরেও ৩ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষার্থী আছে। এসব শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে, যাদের বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু সারটিফিকেশন নেই তাদের জন্য ‘রেকোগ্নিশন অফ প্রাইওর লার্নিং এক্সপেরিয়েন্সের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনালি রেকোগ্নিশন দেওয়ার কার্যক্রম আছে।’

সঠিক প্রশিক্ষণের প্রতি জোর দেওয়ার কথা জানিয়ে জাহাঙ্গির আলম আরো বলেন,শিক্ষার্থীদের স্কিল বাড়ানোর প্রতি জোর দিতে হবে এবং শিক্ষা হতে হবে হ্যান্ডস অন ট্রেইনিং ভিত্তিক। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেন চাকরি পেতে সুবিধা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র অফিসার (অপারেশনস) মোখলেসুর রহমান বলেন, আর্থ-সামাজিকভাবে অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা সহজলভ্য করতে স্কিলস অ্যান্ড ট্রেইনিং ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোজেক্ট (এসটিইপি) বাস্তবায়ন করে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার। এর আওতায় আগের তুলনায় শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার অনেকে বেড়েছে। ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে একটি বিপ্লব ঘটেছে।  

এসটিইপি প্রকল্পের পর বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার ‘এক্সিলারেটিং এন্ড স্ট্রেন্দেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন’ নামে একটি ফলো-আপ প্রজেক্ট চালু করেছে। যেটি এরইমধ্যে ৮০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, গরিব শিক্ষার্থীদের ট্যাবলেট পিসি দিয়ে সহায়তার মাধ্যমে অনলাইন এডুকেশন সিস্টেমে নিয়ে আসা হবে যা করোনাকালে ভাল ভূমিকা রাখবে।

কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্রেইনিংয়ের বড় দুর্বলতা শিক্ষা উপকরণ। বেশিরভাগ জায়গায় শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা তীব্র। বেসরকারি পলিটেকনিক্যালের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ছোট একটি ল্যাব থাকলেও থাকেনা প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। বলা যায়, ব্যবহারিক শিক্ষা হলেও তা চলছে অনেকটা মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর। অন্যদিকে, এখনো পুরনো কোর্স কারিকুলামে চলছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা। কেউ ডিপ্লোমা ইন মাইনিং পড়লেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ এদেশে এই সেক্টরে চাকরির বাজারে এর কোনো চাহিদা নেই। আবার ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’এ  চাহিদা আছে, কারিকুলামেও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাকটিক্যাল অবস্থা ভয়াবহ। অনেকের অভিযোগ এই বিষয়ের ব্যবহারিকের জন্য তাদের ভাল মানের কোনো হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় না।

এই বিষয়ের সঙ্গে একমত জানিয়ে, বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের এই মূখস্ত বিদ্যা থেকে ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। দেশে যদি ৬০ শতাংশের নিচে স্কিলড ফোর্স থাকে তাহলে সে দেশকে উন্নত বলে গন্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম জানান, এরইমধ্যে এ ধরনের দুইটি নতুন প্রজেক্টে কাজ শুরু করেছে সরকার। যেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ টিচার্স ট্রেইনিং থাকবে। পাশাপাশি দেশে ৩২৯টি উপজেলায় নারী হোস্টেলসহ ট্রেইনিং স্কুল তৈরি হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৮ সালের একটি তথ্যে জানা গেছে, দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের হার মাত্র ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র তথ্য বলছে, এটি আসলে মাত্র ৮.৪৪%। অথচ জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ায় এই শিক্ষার হার ৪৬ থেকে ৭০ শতাংশ। যদিও সরকার নতুন করে, আগামি ২০৩০ সাল নাগাদ এই শিক্ষার হার ৩০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

চলমান এইসব বাস্তবতার মধ্যে ১৫ জুলাই এ বছরের বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, চলমান এই কোভিড-১৯ এর সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিকে সুসংগঠিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুবাদের প্রচেষ্টা সবচেয়ে জরুরি। তবে এজন্য দরকার সঠিকভাবে তাদেরকে সহনশীল ও দক্ষ করে গড়ে তোলা।