আফসানা হোসেন সেতু একজন প্রফেশনাল গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তা। আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তার জার্নি শুরু হয় ২০১৬ সালে। জন্ম লালমনিরহাট জেলার দু্রাকুটি গ্রামে। যেহেতু প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা আর ২০১৬ সালের মতো সময়ে আইটি বা অনলাইনে আয় করা যায় এই বিষয়গুলো তখন গ্রামে অনেকটা স্বপ্নের মতো ছিল। তবে এই সেক্টর এ আসার পিছনে তার যে গল্প আছে, সেটা বরং তার মুখ থেকেই শোনা যাক।
আমি পড়াশুনা তে ছোট থেকে খুব ভালো ছিলাম। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম । আর আমার স্কুল এ আমিই প্রথম বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্রী ছিলাম মানে এর আগে আমার স্কুল থেকে কেউ বৃত্তি পায়নি। ঠিক সেভাবেই এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাই। যেহেতু শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং গ্রামে ভালো টিচার নেই তাই টিউশনি পড়তে যেতে হতো প্রায় ৬ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে। স্বপ্ন ছিল মেডিকেল এ পড়ার। মেডিকেল এ পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু চান্স পাইনি আর কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে ভার্সিটি প্রিপারেশন নিতে পারিনি। পরিবারও তেমন একটা সাপোর্ট করেনি। গ্যাপ দিয়ে পরেরবার চেষ্টা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই।
এই যে এত পরিশ্রমের পরও ভালো গাইডলাইন এর অভাবে নিজের স্বপ্নভঙ্গ হোল এই বিষয়গুলো নিয়ে চরম ডিপ্রেশনে পড়ে যাই সেটা থেকে বের হতে গিয়ে ভাবলাম কিছু করতে হবে। তখন আমাদের এলাকায় হাতে গোনা কয়েকজন ফ্রিলান্সিং শিখছে। তো আব্বুকে বলার পরে আব্বু আমাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেয় এবং আমি একটা ট্রেনিং সেন্টার এ ভর্তি হই। তো আমার ট্রেনিং এর এক মাসের মাথায় আমার ইমপ্রুভমেন্ট দেখে আমার ট্রেইনার আমাকে ফাইভারে (একটা ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেস) এ একটা আইডি খুলে দেয়। আর তখন শুরু হয় আমার গুগল এ রিসার্চ করা। যে বিষয়গুলো আমি ট্রেনিং থেকে শিখেছি তার থেকে অনেক বেশি বিষয় আমি গুগল থেকে শিয়েছি। কিভাবে মার্কেটিং করতে হয়, কিভাবে বায়ার সামলাতে হয় ইত্যাদি। আর গ্রামে যে নেটওয়ার্ক এর অবস্থা এমনও সময় গেছে শীতের রাতে সারারাত উঠানে বসে কাজ করতে হয়েছে।
কাজ শুরুর প্রথম মাসে আমার প্রায় ১০০০০ টাকা আয় হয়। এটা তখন আমার কাছে অনেক বড় একটা পাওয়া। কারণ সেই সময়ে ঘরে বসে দশ হাজার টাকা আয় মানে বিশাল কিছু। এরপর ফাইভার থেকে আমার সাফল্য শুরু। দুই মাসেই লেভেল টু সেলার হয়ে যাই এবং এক বছরে প্রায় তিন লক্ষ টাকা ইনকাম করি এবং এরপর থেকে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকম অনলাইন এবং অফলাইন কোর্স এর মাধ্যমে নিজেকে ডেভেলপ করার চেষ্টা করি।
আমি কখনো নিজের কাজকে পেছনে পরতে দেইনি। প্রতিনয়ত সব কিছুকে ডেভেলপ করার চেষ্টা করেছি। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিয়েছি এবার। এই সব কিছুর মাঝে নিজের উদ্যোগকেও সাথে করে পথ চলেছি। কারণ আমি বুঝে গেছি আইটির সাথে আমি যেভাবে জুড়ে গেছি এটাই এখন আমার প্যাশন এবং প্রফেশন। এখন সংসার বাচ্চা একা হাতে সামলে নিজের উদ্যোগ সামলাতে অনেক কষ্ট হয় ঠিকই কিন্তু এই সেক্টরে আমার যে প্যাশন তৈরি হয়েছে সেটা কে কাজে লাগিয়ে নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছি। ঐ যে যেখানে স্বপ্ন আর ইচ্ছা থাকে সেখানে সব সম্ভব হয় বিয়য়টা এমন।
সেই প্যাশন থেকে এবং গ্রাফিক ডিজাইন, ব্রান্ড আইডেন্টিটি এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট শিল্পে দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে ২০২০ সালের ডিসেম্বর এর দিকে Design Maniac নামে আমি একটি উদ্যোগ শুরু করি। শুরুর দিকে গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ওয়েবসাইট টেম্পলেট নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে কর্পোরেট ব্রান্ড আইডেন্টিটি, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ই-কমার্স সার্ভিস এবং সব রকম প্রিন্ট আইটেম গুলো সরবরাহ করছি (ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার, ফ্লায়ার, ব্রুশিয়ার, কোম্পানি প্রফাইল, ইনভয়েস, শপিং ব্যাগ ইত্যাদি)। আমার টিমে ৩ জন কর্মী আছে । এরইমধ্যে এই সেক্টরে ৩৫০ এরও অধিক উদ্যোক্তাদের ব্রান্ড আইডেন্টিটি এবং প্রিন্টিং নিয়ে কাজ করেছি। আমি উইয়ের (Women and e-Commerce Trust) এর সাথে যুক্ত আছি গত বছরের আগস্ট থেকে এবং ইতোমধ্যে উইয়ের প্রায় ২০০ জন উদ্যোক্তা Design Maniac থেকে গ্রাফিক্স এবং প্রিন্ট রিলেটেড সল্যুশন নিয়েছেন। উইয়ের সাথে কাজ করছি নিয়মিত আর খুব অল্প সময়ে উই এর লাখপতির খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছি। আমার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫০ জন সদস্য সম্বলিত একটি টিম গঠন করা এবং যেটি একটি নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হবে এবং যার বাৎসরিক টার্নওভার থাকবে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।
আর আমার আর একটা স্বপ্ন আমার একটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থাকবে Design Maniac School নামে। যেখানে নারীদের আইটি সেক্টরে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে আর আমাদের দেশে যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এফ কমার্স নির্ভর বিজনেস করে তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এর সিস্টেম থাকবে যেন নিজেদের পেজ রিলেটেড সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে এটা নিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনাও নিয়েছি।